কিডনি রোগ:প্রতিরোধ সম্ভব
৪ মিলিগ্রাম এর উপরে ৩ মাস বা ততধিক কাল স্থায়ী থাকে তখন তাকে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগী হিসাবে সনাক্ত করা হয়।
দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের জটিলতা:দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের সবচেয়ে অসুবিধা হলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ ধরনের রোগীদের কোন উপসর্গ হয় না। ফলে বছরের পর বছর এরা চিকিৎসকের শরনাপন্ন হয় না। যখন তাদের উপসর্গ দেখা দেয় তখন তাদের কিডনির কার্যকারিতা ৭৫ শতাংশ লোপ পায়। কিডনি কার্যকারিতা ৭৫ শতাংশ লোপ পাওয়ার পরে ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা করে পরিপূর্ণ সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে আনা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। ফলে কিডনি যখন ক্রমান্বয়ে সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে পড়ে তখন তারা মৃতু্যর কোলে ঢলে পড়ে। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে যদি দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ নিরূপন করা যেত তাহলে চিকিৎসার মাধ্যমে এই রোগগুলোকে আংশিক বা পরিপূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব হতো। সুতরাং কোন রোগী দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে ভুগছে কিনা, এজন্য জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি অত্যন্ত জরুরী।
দরকার নিয়মিত পরীক্ষা-নিরিক্ষা:শুধুমাত্র সচেতনতার মাধ্যমেই একজন রোগীর কিডনি রোগ আছে কিনা তা জানা সম্ভব। যেমন: যে কোন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের উপসর্গ থাকুক বা না থাকুক তার রক্তচাপ নিয়মিত পরিমাপ করা, প্রস্রাবে অ্যালবুমিন নির্গত হচ্ছে কিনা তা জানা এবং ডায়াবেটিস আছে কিনা তা নিরূপন করা প্রয়োজন। যদি কারো ডায়াবেটিস ধরা পড়ে অথবা ডায়াবেটিসে ভুগে থাকেন তাকে অন্ততঃ বছরে ১ বার প্রস্রাবে অ্যালবুমিন এবং মাইক্রো অ্যালবুমিন যাচ্ছে কিনা এবং রক্তে ক্রিয়েটিনিন স্বাভাবিক কিনা তা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। উচ্চ রক্তচাপের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য।
কিডনি রোগের ভয়াবহতা:বেশীর ভাগ দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের কোন উপসর্গ হয় না। তাই তারা ডাক্তারের শরণাপন্ন হয় না। সুতরাং দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের উপসর্গগুলো সমন্ধে সকলের ধারণা থাকা প্রয়োজন। যদিও দীর্ঘস্থায়ী কিডনি অকেজো রোগে বমি বমি ভাব, ক্ষুধা-মন্দা, রক্ত সল্পতা, শরীরে পানি জমা, শ্বাস কষ্ট এবং প্রস্রাবের পরিমাণের তারতম্য, চর্মরোগ ছাড়াই শরীর চুলকানো এবং ক্রমান্বয়ে দৈনন্দিন কার্যকারিতা লোপ পাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। আমাদের দেশে শতকরা ৮০ ভাগ কিডনি রোগী এই উপসর্গগুলো নিয়েই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয় এবং রক্ত পরীক্ষায় দেখা যায় যে, কিডনির ৮০ ভাগ কার্যকারিতাই তখন নষ্ট হয়ে গেছে। দীর্ঘস্থায়ী কিডনি অকেজো হওয়ার ফলে উপরিউক্ত উপসর্গ ছাড়াও শরীরে অনেক জটিলতা দেখা দেয়। যার মধ্যে প্রধান হলো হূৎপিন্ডের রোগ।
দেশে ১ কোটি ৮০ লাখ কিডনি রোগী: বাংলাদেশে কিডনি ফাউন্ডেশন এবং বিএসএমএমইউ-র উদ্যোগে সাভারের চাকুলিয়া গ্রামে বিগত ৩ বছর ধরে কতজনের দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ রয়েছে তার উপর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রায় ৩ হাজার প্রাপ্ত বয়স্ক লোকের উপর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, প্রায় শতকরা ১৮ ভাগ মানুষ দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত। এদের মধ্যে শতকরা ১৩ ভাগ রোগীর রক্তে ক্রিয়েটিনিন স্বাভাবিকের চেয়ে উপরে অথর্াৎ তাদের কিডনির কার্যকারিতা ক্রমান্বেয়ে হ্রাস পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৩ সালে ১৫,৬২৫ জন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের উপর সমীক্ষায় দেখা যায় যে, এদের ১১ ভাগ দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত। অস্ট্রেলিয়ায় এই সংখ্যা ১৬% এবং আইসল্যান্ড ১০%। এই সমীক্ষা থেকে এটা প্রতিয়মান হয় যে, বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ লোক দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে ভুগছে।
প্রতিবছর মারা যায় ৪০ হাজার:বিভিন্ন হাসপাতালের পরিসংখ্যান থেকে এটা ধারণা করা হয়-বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার রোগীর কিডনি সম্পূর্ণভাবে অকেজো হয়ে মারা যায়। এই উধর্্বহারে কিডনি অকেজো হওয়ার কারণ হিসাবে নেফ্রাট্রিস, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপকেই দায়ী করা হয়ে থাকে। নেফ্রাইটিস রোগের প্রধান কারণ হিসাবে বিবেচিত হওয়ার জন্য ব্যাকটেরিয়া জনিত ইনফেকশন, ভাইরাল হেপাটাইটিস, যহ্মা, ম্যালেরিয়া, কালা-জ্বর এবং ওষুধের পাশর্্বপ্রতিক্রিয়াকে দায়ী করা হয়। খাবারে রাসায়নিক পদার্থ মিশানো এবং ভেজাল, ক্রনিক ইন্টারস্টেশিয়াল নেফ্রাইটিস এর কারণ হিসাবে দায়ী করা যেতে পারে। এমনকি পানিতে অধিক পরিমানে আর্সেনিক কিডনি রোগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে। মার্কারি, লেড, গোল্ড এবং অন্যান্য ধাতব পদার্থ কিডনি রোগের কারণ হতে পারে। হেপাটাইটিস 'বি' এবং 'সি' ভাইরাস এইচআইভি ভাইরাস দক্ষিণ আফ্রিকাতে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের একটি বড় কারণ। ঠিক তেমনি ম্যালেরিয়া আফ্রিকা মহাদেশে কিডনি রোগের কারণ হিসাবে বিবেচিত।
কিডনি অকেজো রোগীর চিকিৎসা:কিডনি সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে গেলে শুধু ওষুধের মাধ্যমে রোগীকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। রোগীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন হয় নিয়মিত ডায়ালাইসিস অথবা কিডনি সংযোজন। বর্তমান বিশ্বে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করে একজন রোগী ৫ থেকে ১৫ বছর এবং সফল কিডনি সংযোজনের মাধ্যমে ১০-১৫ বছর স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। পৃথিবীতে নিয়মিত হেমোডায়ালাইসিসের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৩০ বছর পর্যন্ত রোগী বেঁচে আছে এবং সফল কিডনি সংযোজনের ক্ষেত্রে প্রায় ৩৩ বছর বেঁচে থাকার রেকর্ড রয়েছে। (নিয়মিত ডায়ালাইসিস বলতে সপ্তাহে ৩ বার ৪ ঘন্টা করে হেমোডায়ালাইসিস মেশিনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা বুঝায়।) ঠিক তেমনি নিকট আত্মীয়ের কিডনি নিয়ে প্রতিস্থাপনকে কিডনি সংযোজন বোঝায়। অবশ্য উন্নত বিশ্বে মৃত ব্যক্তির কিডনি নিয়ে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই কিডনি সংযোজন করা হয়ে থাকে।
কিডনি রোগ সনাক্ত করা দরকার:বর্তমানে উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ কিভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব তা নিয়ে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। গ্রাম ও শহর পর্যায়ে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ সনাক্ত করে তা চিকিৎসার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে গ্রাম পর্যায়ের চলমান গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৮% যাদের মধ্যে ১৮.৫% এরই উচ্চ রক্তচাপ, ৫% ডায়াবেটিস এবং ৬% প্রস্রাবে প্রোটিন নির্গত হয়। এই ৫% ডায়াবেটিস রোগীর ৩০ শতাংশ এবং ১৮% উচ্চ রক্তচাপের ১৫% এবং ৬% রোগীর যাদের প্রস্রাবে প্রোটিন নির্গত হয় সবাই দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত বলে ধারণা করা হয়। উক্ত সমীক্ষায় রোগীদের প্রশ্ন রাখা হয়েছিল তারা ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ এবং প্রস্রাব প্রোটিন নির্গত হওয়া সম্পর্কে জানেন কি না। শতকরা ৬০% রোগী জানেই না যে তাদের ডায়াবেটিস উচ্চ রক্তচাপ অথবা প্রস্রাবে প্রোটিন নির্গত হয় এবং তারা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়নি। সুতরাং এই রোগীগুলোই দীর্ঘস্থায়ী কিডনি অকেজো রোগে ভুগে ক্রমান্বয়ে সম্পূর্ণভাবে কিডনি বিনষ্ট হয়। এই রোগীগুলোকেই সনাক্ত করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত।
কিডনি রোগ প্রতিরোধের উপায়:এটা পরীক্ষিত যে, এসিই-ইনহেবিটরস এবং এআরবি জাতীয় উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ কিডনি রোগ প্রতিরোধে খুবই কার্যকর। ঠিক তেমনি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা মাইক্রো-অ্যালবুমিন ধরা পড়লে জরুরীভিত্তিতে চিকিৎসা করা প্রয়োজন। এছাড়া নিয়মিত ব্যায়াম, ফাস্টফুড না খাওয়া, চর্বি জাতীয় খাবারের প্রতি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা গেলে কিডনি রোগ প্রতিরোধ সম্ভব। এছারাও ক্ষেত্রবিশেষে চর্বি নিয়ন্ত্রণকারী ওষুধ খেলে, ধুমপান না করলে কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা যায় এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত হূদরোগ থেকেও রেহাই পাওয়া যায়।
কিডনি রোগীদের সচেতন করে এবং প্রাথমিক পর্যায়ে এ রোগ সনাক্তকরণের সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে লক্ষ লক্ষ কিডনি রোগীর কিডনি সম্পূর্ণ নষ্ট হওয়া থেকে অনেকাংশে রক্ষা পাবে। পাশাপাশি কিডনি অকোজো রোগীরা ডায়ালাইসিস ও কিডনি সংযোজনের বিশাল খরচ থেকে মুক্তি পাবে।
**************************
দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ কি:কিডনি যখন নিজস্ব কোন রোগে আক্রান্ত হয় অথবা অন্য কোন রোগে কিডনি আক্রান্ত হয়, যার ফলে কিডনির কার্যকারিতা ৩ মাস বা ততোধিক সময় পর্যন্ত লোপ পেয়ে থাকে তখন তাকে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ বলা হয়। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে যদি কিডনি রোগ ছাড়াও কিডনির কার্যকারিতা লোপ পায় তাহলেও তাকে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ বলা যেতে পারে। যেমন-ক্রনিক নেফ্রাইটিস কিডনির ফিল্টারকে আক্রমণ করে ক্রমান্বয়ে কিডনির কার্যকারিতা কমিয়ে ফেলতে পারে। ফলে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ হতে পারে। ঠিক তেমনি ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ কিডনি রোগ না হওয়া সত্ত্বেও কিডনির ফিল্টার/ছাঁকনি ধ্বংস করতে পারে। আবার কারও যদি জন্মগতভাবে কিডনির কার্যকারিতা কম থাকে অথবা কিডনির আকার ছোট বা বেশী বড় থাকে তাহলেও দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ হতে পারে।
কিডনির ছাকনী: মানুষ জন্মগ্রহণ করার ৬ সপ্তাহের মধ্যেই কিডনির ছাকনি বা ফিল্টার মেমব্রেন পুরোপুরি তৈরী হয়ে যায়। অর্থাৎ কিডনি পুরোদমে কাজ শুরু করতে পারে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির প্রতিটি কিডনিতে প্রায় ১০-১২ লক্ষ ছাকনি রয়েছে এবং প্রতি ২৪ ঘন্টায় ১৭০ লিটার রক্ত পরিশোধন করে। এই পরিশোধিত রক্তের মধ্যে ১-৩ লিটার শরীরের বর্জ্য পদার্থ প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দেয়া হয়। সুতরাং কোন কারণবশতঃ যদি এ ধরনের ফিল্টার বাঁধাপ্রাপ্ত হয় তখন দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ হতে পারে।
কিডনির কার্যকারিতা যাচাই করার জন্য রক্তে ক্রিয়েটিনিন নামক জৈব পদার্থ পরিমাপ করা হয় যার মাধ্যমে কিডনি কতটুকু কাজ করছে তা বোঝা যায়। দুঃখজনক বিষয় হলো- এই জৈব পদার্থটি ৫০ শতাংশ কিডনির কার্যকারিতা নষ্ট হওয়ার পরেই শরীরে বাড়তে পারে। একজন সুস্থ পুরুষ লোকের শরীরে ক্রিয়েটিনিন ১.৪ মিলিগ্রাম এবং মহিলা ১.৩ মিলিগ্রাম হিসেবে স্বাভাবিক ধরা হয়। যদি এই ক্রিটিনিন পুরুষের ক্ষেত্রে ১.
কিডনির ছাকনী: মানুষ জন্মগ্রহণ করার ৬ সপ্তাহের মধ্যেই কিডনির ছাকনি বা ফিল্টার মেমব্রেন পুরোপুরি তৈরী হয়ে যায়। অর্থাৎ কিডনি পুরোদমে কাজ শুরু করতে পারে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির প্রতিটি কিডনিতে প্রায় ১০-১২ লক্ষ ছাকনি রয়েছে এবং প্রতি ২৪ ঘন্টায় ১৭০ লিটার রক্ত পরিশোধন করে। এই পরিশোধিত রক্তের মধ্যে ১-৩ লিটার শরীরের বর্জ্য পদার্থ প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দেয়া হয়। সুতরাং কোন কারণবশতঃ যদি এ ধরনের ফিল্টার বাঁধাপ্রাপ্ত হয় তখন দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ হতে পারে।
কিডনির কার্যকারিতা যাচাই করার জন্য রক্তে ক্রিয়েটিনিন নামক জৈব পদার্থ পরিমাপ করা হয় যার মাধ্যমে কিডনি কতটুকু কাজ করছে তা বোঝা যায়। দুঃখজনক বিষয় হলো- এই জৈব পদার্থটি ৫০ শতাংশ কিডনির কার্যকারিতা নষ্ট হওয়ার পরেই শরীরে বাড়তে পারে। একজন সুস্থ পুরুষ লোকের শরীরে ক্রিয়েটিনিন ১.৪ মিলিগ্রাম এবং মহিলা ১.৩ মিলিগ্রাম হিসেবে স্বাভাবিক ধরা হয়। যদি এই ক্রিটিনিন পুরুষের ক্ষেত্রে ১.
দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের জটিলতা:দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের সবচেয়ে অসুবিধা হলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ ধরনের রোগীদের কোন উপসর্গ হয় না। ফলে বছরের পর বছর এরা চিকিৎসকের শরনাপন্ন হয় না। যখন তাদের উপসর্গ দেখা দেয় তখন তাদের কিডনির কার্যকারিতা ৭৫ শতাংশ লোপ পায়। কিডনি কার্যকারিতা ৭৫ শতাংশ লোপ পাওয়ার পরে ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা করে পরিপূর্ণ সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে আনা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। ফলে কিডনি যখন ক্রমান্বয়ে সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে পড়ে তখন তারা মৃতু্যর কোলে ঢলে পড়ে। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে যদি দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ নিরূপন করা যেত তাহলে চিকিৎসার মাধ্যমে এই রোগগুলোকে আংশিক বা পরিপূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব হতো। সুতরাং কোন রোগী দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে ভুগছে কিনা, এজন্য জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি অত্যন্ত জরুরী।
দরকার নিয়মিত পরীক্ষা-নিরিক্ষা:শুধুমাত্র সচেতনতার মাধ্যমেই একজন রোগীর কিডনি রোগ আছে কিনা তা জানা সম্ভব। যেমন: যে কোন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের উপসর্গ থাকুক বা না থাকুক তার রক্তচাপ নিয়মিত পরিমাপ করা, প্রস্রাবে অ্যালবুমিন নির্গত হচ্ছে কিনা তা জানা এবং ডায়াবেটিস আছে কিনা তা নিরূপন করা প্রয়োজন। যদি কারো ডায়াবেটিস ধরা পড়ে অথবা ডায়াবেটিসে ভুগে থাকেন তাকে অন্ততঃ বছরে ১ বার প্রস্রাবে অ্যালবুমিন এবং মাইক্রো অ্যালবুমিন যাচ্ছে কিনা এবং রক্তে ক্রিয়েটিনিন স্বাভাবিক কিনা তা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। উচ্চ রক্তচাপের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য।
কিডনি রোগের ভয়াবহতা:বেশীর ভাগ দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের কোন উপসর্গ হয় না। তাই তারা ডাক্তারের শরণাপন্ন হয় না। সুতরাং দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের উপসর্গগুলো সমন্ধে সকলের ধারণা থাকা প্রয়োজন। যদিও দীর্ঘস্থায়ী কিডনি অকেজো রোগে বমি বমি ভাব, ক্ষুধা-মন্দা, রক্ত সল্পতা, শরীরে পানি জমা, শ্বাস কষ্ট এবং প্রস্রাবের পরিমাণের তারতম্য, চর্মরোগ ছাড়াই শরীর চুলকানো এবং ক্রমান্বয়ে দৈনন্দিন কার্যকারিতা লোপ পাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। আমাদের দেশে শতকরা ৮০ ভাগ কিডনি রোগী এই উপসর্গগুলো নিয়েই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয় এবং রক্ত পরীক্ষায় দেখা যায় যে, কিডনির ৮০ ভাগ কার্যকারিতাই তখন নষ্ট হয়ে গেছে। দীর্ঘস্থায়ী কিডনি অকেজো হওয়ার ফলে উপরিউক্ত উপসর্গ ছাড়াও শরীরে অনেক জটিলতা দেখা দেয়। যার মধ্যে প্রধান হলো হূৎপিন্ডের রোগ।
দেশে ১ কোটি ৮০ লাখ কিডনি রোগী: বাংলাদেশে কিডনি ফাউন্ডেশন এবং বিএসএমএমইউ-র উদ্যোগে সাভারের চাকুলিয়া গ্রামে বিগত ৩ বছর ধরে কতজনের দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ রয়েছে তার উপর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রায় ৩ হাজার প্রাপ্ত বয়স্ক লোকের উপর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, প্রায় শতকরা ১৮ ভাগ মানুষ দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত। এদের মধ্যে শতকরা ১৩ ভাগ রোগীর রক্তে ক্রিয়েটিনিন স্বাভাবিকের চেয়ে উপরে অথর্াৎ তাদের কিডনির কার্যকারিতা ক্রমান্বেয়ে হ্রাস পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৩ সালে ১৫,৬২৫ জন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের উপর সমীক্ষায় দেখা যায় যে, এদের ১১ ভাগ দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত। অস্ট্রেলিয়ায় এই সংখ্যা ১৬% এবং আইসল্যান্ড ১০%। এই সমীক্ষা থেকে এটা প্রতিয়মান হয় যে, বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ লোক দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে ভুগছে।
প্রতিবছর মারা যায় ৪০ হাজার:বিভিন্ন হাসপাতালের পরিসংখ্যান থেকে এটা ধারণা করা হয়-বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার রোগীর কিডনি সম্পূর্ণভাবে অকেজো হয়ে মারা যায়। এই উধর্্বহারে কিডনি অকেজো হওয়ার কারণ হিসাবে নেফ্রাট্রিস, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপকেই দায়ী করা হয়ে থাকে। নেফ্রাইটিস রোগের প্রধান কারণ হিসাবে বিবেচিত হওয়ার জন্য ব্যাকটেরিয়া জনিত ইনফেকশন, ভাইরাল হেপাটাইটিস, যহ্মা, ম্যালেরিয়া, কালা-জ্বর এবং ওষুধের পাশর্্বপ্রতিক্রিয়াকে দায়ী করা হয়। খাবারে রাসায়নিক পদার্থ মিশানো এবং ভেজাল, ক্রনিক ইন্টারস্টেশিয়াল নেফ্রাইটিস এর কারণ হিসাবে দায়ী করা যেতে পারে। এমনকি পানিতে অধিক পরিমানে আর্সেনিক কিডনি রোগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে। মার্কারি, লেড, গোল্ড এবং অন্যান্য ধাতব পদার্থ কিডনি রোগের কারণ হতে পারে। হেপাটাইটিস 'বি' এবং 'সি' ভাইরাস এইচআইভি ভাইরাস দক্ষিণ আফ্রিকাতে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের একটি বড় কারণ। ঠিক তেমনি ম্যালেরিয়া আফ্রিকা মহাদেশে কিডনি রোগের কারণ হিসাবে বিবেচিত।
কিডনি অকেজো রোগীর চিকিৎসা:কিডনি সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে গেলে শুধু ওষুধের মাধ্যমে রোগীকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। রোগীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন হয় নিয়মিত ডায়ালাইসিস অথবা কিডনি সংযোজন। বর্তমান বিশ্বে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করে একজন রোগী ৫ থেকে ১৫ বছর এবং সফল কিডনি সংযোজনের মাধ্যমে ১০-১৫ বছর স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। পৃথিবীতে নিয়মিত হেমোডায়ালাইসিসের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৩০ বছর পর্যন্ত রোগী বেঁচে আছে এবং সফল কিডনি সংযোজনের ক্ষেত্রে প্রায় ৩৩ বছর বেঁচে থাকার রেকর্ড রয়েছে। (নিয়মিত ডায়ালাইসিস বলতে সপ্তাহে ৩ বার ৪ ঘন্টা করে হেমোডায়ালাইসিস মেশিনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা বুঝায়।) ঠিক তেমনি নিকট আত্মীয়ের কিডনি নিয়ে প্রতিস্থাপনকে কিডনি সংযোজন বোঝায়। অবশ্য উন্নত বিশ্বে মৃত ব্যক্তির কিডনি নিয়ে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই কিডনি সংযোজন করা হয়ে থাকে।
কিডনি রোগ সনাক্ত করা দরকার:বর্তমানে উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ কিভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব তা নিয়ে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। গ্রাম ও শহর পর্যায়ে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ সনাক্ত করে তা চিকিৎসার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে গ্রাম পর্যায়ের চলমান গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৮% যাদের মধ্যে ১৮.৫% এরই উচ্চ রক্তচাপ, ৫% ডায়াবেটিস এবং ৬% প্রস্রাবে প্রোটিন নির্গত হয়। এই ৫% ডায়াবেটিস রোগীর ৩০ শতাংশ এবং ১৮% উচ্চ রক্তচাপের ১৫% এবং ৬% রোগীর যাদের প্রস্রাবে প্রোটিন নির্গত হয় সবাই দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত বলে ধারণা করা হয়। উক্ত সমীক্ষায় রোগীদের প্রশ্ন রাখা হয়েছিল তারা ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ এবং প্রস্রাব প্রোটিন নির্গত হওয়া সম্পর্কে জানেন কি না। শতকরা ৬০% রোগী জানেই না যে তাদের ডায়াবেটিস উচ্চ রক্তচাপ অথবা প্রস্রাবে প্রোটিন নির্গত হয় এবং তারা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়নি। সুতরাং এই রোগীগুলোই দীর্ঘস্থায়ী কিডনি অকেজো রোগে ভুগে ক্রমান্বয়ে সম্পূর্ণভাবে কিডনি বিনষ্ট হয়। এই রোগীগুলোকেই সনাক্ত করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত।
কিডনি রোগ প্রতিরোধের উপায়:এটা পরীক্ষিত যে, এসিই-ইনহেবিটরস এবং এআরবি জাতীয় উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ কিডনি রোগ প্রতিরোধে খুবই কার্যকর। ঠিক তেমনি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা মাইক্রো-অ্যালবুমিন ধরা পড়লে জরুরীভিত্তিতে চিকিৎসা করা প্রয়োজন। এছাড়া নিয়মিত ব্যায়াম, ফাস্টফুড না খাওয়া, চর্বি জাতীয় খাবারের প্রতি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা গেলে কিডনি রোগ প্রতিরোধ সম্ভব। এছারাও ক্ষেত্রবিশেষে চর্বি নিয়ন্ত্রণকারী ওষুধ খেলে, ধুমপান না করলে কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা যায় এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত হূদরোগ থেকেও রেহাই পাওয়া যায়।
কিডনি রোগীদের সচেতন করে এবং প্রাথমিক পর্যায়ে এ রোগ সনাক্তকরণের সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে লক্ষ লক্ষ কিডনি রোগীর কিডনি সম্পূর্ণ নষ্ট হওয়া থেকে অনেকাংশে রক্ষা পাবে। পাশাপাশি কিডনি অকোজো রোগীরা ডায়ালাইসিস ও কিডনি সংযোজনের বিশাল খরচ থেকে মুক্তি পাবে।
**************************
অধ্যাপক হারুন আর রশিদ
সভাপতি, কিডনি ফাউন্ডেশন ও
বাংলাদেশ রেনাল এসোসিয়েশন
সভাপতি, কিডনি ফাউন্ডেশন ও
বাংলাদেশ রেনাল এসোসিয়েশন
দৈনিক ইত্তেফাক, ১২ মার্চ ২০১১
0 মন্তব্য(গুলি):
Post a Comment